
যুগের নারায়ণগঞ্জ:
মাসুদুজ্জামান ওরফে মডেল মাসুদ নারায়ণগঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় দেশের শীর্ষ পর্যায়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। বিএনপি’র পক্ষ থেকেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পরেন। খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নারায়ণগঞ্জে এসে মাসুদুজ্জামান এর এমন নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরে যান!
এতকিছুর পরও তিনি আবার গিরগিটির মতো রং পাল্টে নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন !
মহানগর প্রতিনিধি :
“এ তো দেখছি গিরগিটির মতো রং পাল্টাচ্ছেন”— নারায়ণগঞ্জ শহরের বোস কেবিনের এক আড্ডায় প্রবীণদের এই মন্তব্য এখন আর শুধু কফি-চায়ের টেবিলেই সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে। আলোচনার কেন্দ্রে মডেল গ্রুপের কর্ণধার মাসুদুজ্জামান ওরফে ‘মডেল মাসুদ’। প্রশ্ন একটাই— তিনি আসলে কী চান? নির্বাচন, না কি ক্ষমতার পালাবদলে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখার আরেকটি কৌশল ?
স্থিরতা নেই, বিতর্কই পরিচয় ?
প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মাসুদুজ্জামান কখনোই স্থির রাজনৈতিক অবস্থানের মানুষ নন। পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান যেমন এলাকাবাসীর অজানা নয়, তেমনি ব্যবসায়িকভাবে সফল হলেও রাজনীতিতে পা রাখার পর থেকেই তিনি একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসছেন!
আওয়ামী লীগ আমল ও ‘অদৃশ্য আঁতাত’
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে সিটিজেন ব্যাংকের মালিকানা ও হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় ছিল মাসুদুজ্জামান ওরফে মডেল মাসুদের বিরুদ্ধে। একই সময়ে নারায়ণগঞ্জে নিজ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ওসমান পরিবারের সেলিম ওসমান এবং শামীম ওসমানের সঙ্গে গোপন আঁতাতের অভিযোগও উঠে আসে এই মাসুদের বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে সময়কার অসংখ্য ছবি আজও সাক্ষ্য দেয় সেই ঘনিষ্ঠতার।
৫ আগস্টের পর প্রথম রং বদল
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরপরই দৃশ্যমান হয় মাসুদের প্রথম বড় রাজনৈতিক রং পরিবর্তন। নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের চেয়ার দখল করে তিনি নিজেকে নতুন বাস্তবতায় মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এখানেই শেষ নয়— বিতর্কিত চরিত্র ও ওসমান পরিবারের নির্ভরযোগ্য দালাল হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ হাতেমকে সঙ্গে নিয়ে বিকেএমইএ ও চেম্বার অব কমার্স দখলের লক্ষ্যে ‘চাঁদাবাজির নাটক’ মঞ্চায়নেরও অভিযোগ ওঠে।
পরবর্তীতে চাঁদা ফেরত দেওয়ার হুমকি, নাম প্রকাশ না করে সাংবাদিক সম্মেলন, আবার অজ্ঞাত কারণে সেই চাঁদার টাকা ফেরত— সব মিলিয়ে ঘটনাগুলো অনেকের কাছেই সাজানো নাটক বলেই মনে হয়েছে!
বিএনপি অধ্যায় : বিতর্কের নতুন অধ্যায়
এরপর হঠাৎ করেই ঘোষণা— তিনি বিএনপির টিকিটে নির্বাচন করবেন। কিন্তু এখানেই শুরু হয় আরেক ঝড়। বিএনপি নেতা সাখাওয়াত হোসেন খান ও আবু আল ইউসুফ খান টিপু প্রকাশ্যে তিরস্কার করে বলেন, “মাসুদ বিএনপির কেউ না, উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন।”
এমনকি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়— মাসুদের সঙ্গে কোনো বিএনপি নেতার ঘনিষ্ঠ ছবি দেখাতে পারলে মেনে নেওয়া হবে যে তিনি বিএনপির রাজনীতি করতেন। বিপরীতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ আমলের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও ওসমান পরিবারের সঙ্গে মাসুদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের অসংখ্য ছবি।
মনোনয়ন, প্রত্যাহার, আবার ঘোষণা
সব বিতর্কের মধ্যেই কৌশলী তৎপরতায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন নিশ্চিত করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এতে বিএনপির ভেতরেই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়— কেউ কেউ আপস করলেও অনেক নেতা প্রকাশ্যে ও নীরবে তার বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন।
এরপর নাটকীয় মোড়— নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার ও নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন মডেল মাসুদ। কিন্তু নাটক এখানেই থামেনি। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে, শুক্রবার ১৯ ডিসেম্বর, মডেল গার্মেন্টসের সামনে আবারও নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে ঘোষণা দেন— তিনি নির্বাচন করবেন।
শেষ প্রশ্ন: আসলে কী চান মাসুদ ?
এক বছরে একাধিকবার অবস্থান বদল, একেক সময় একেক ঘোষণা, ক্ষমতার পালাবদলে দ্রুত রং পরিবর্তন— এসব দেখে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠছে, মাসুদুজ্জামান কি আদৌ নির্বাচন করতে চান, নাকি তিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন নিজের ব্যবসা ও প্রভাব টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, “এটা যদি রাজনীতি হয়, তবে তা আদর্শের নয়— সুযোগের রাজনীতি।” আর সেই সুযোগের রাজনীতির গিরগিটি রূপ এখন নারায়ণগঞ্জবাসীর সামনে নগ্ন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।