যুগের নারায়ণগঞ্জ:
নিরাপদ ও শান্তিময় নারায়ণগঞ্জ গড়ার প্রত্যয়
গত দুই দশকে ‘সন্ত্রাসের নগরী’ হিসেবে পরিচয় পাওয়া নারায়ণগঞ্জ নগরীকে নিরাপদ ও শান্তিময় হিসেবে গড়ার লক্ষ্যে ঐকমত্য পোষণ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, নাগরিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা। বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে গোড়াপত্তন হওয়া নারায়ণগঞ্জের পুরোনো ঐতিহ্য ফেরাতে তারা রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনার তাগিদ দিয়েছেন। এজন্য সকল ইতিবাচক শক্তিকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়।
শনিবার (১১ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সপ্তম তলায় ‘আমার নারায়ণগঞ্জ’ নামে একটি নতুন নাগরিক সংগঠনের উদ্যোগে ‘আমরা কেমন নারায়ণগঞ্জ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা।
সকাল এগারোটায় শুরু হওয়া এ আয়োজন চলে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি মো. মাসুদুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ গোলটেবিল বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক, ব্যবসায়িক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা নারায়ণগঞ্জ শহর নিয়ে তাদের ভাবনা ও বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের কথা তুলে ধরেন।
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইতিবাচক নারায়ণগঞ্জ গড়া সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তারা।
মাসুদুজ্জামানের শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে নারায়ণগঞ্জের গোড়াপত্তনের ইতিহাস তুলে ধরেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি।
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সুন্দর নগর গড়তে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকে নারায়ণগঞ্জের গৌরব বহু পুরোনো। কিছু সন্ত্রাসী তকমার কারণে আমাদের সে গৌরবগুলো চাপা পড়ে গেছে। এ শহরে ওসমান পরিবার দাবড়ে বেরিয়েছে। লাশের পর লাশ ফেলেছে, টর্চার সেলে মানুষকে নির্যাতন করেছে।’
যানজট নিরসনের তাগিদ দিয়ে রাব্বি বলেন, ‘আমরা আমাদের নারায়ণগঞ্জ গড়বো। পুলিশ, প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন কেউই তাদের কাজ করছে না। সুতরাং প্রয়োজনে প্রশাসনকে আমরা বাধ্য করবো।’
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘ইতিবাচক নারায়ণগঞ্জ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের স্বপ্ন অনেক। আমাদের চাহিদার তালিকাও অনেক বড়। স্বপ্ন অনেক দেখা যায় কিন্তু তা বাস্তবায়নে জ্ঞানী-গুণীদের সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নারায়ণগঞ্জ অনেক ভূমিকা রাখলেও কারও কারও আচরণের কারণে এ শহরের দুর্নাম হয়েছে। আগামীতে যাতে আমাদের শহর নিয়ে সগৌরবে কথা বলতে পারি সেজন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন নেতৃত্ব আমরা দেখতে চাই।’
প্রশাসনের উপর জনগণের ‘চাপ’ বজায় রাখতে হবে মন্তব্য করে এ রাজনীতিক আরও বলেন, ‘ডিসি-এসপিরা পাবলিক সার্ভেন্ট। সুতরাং তাদেরও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন করে ব্যক্তিস্বার্থের দেন-দরবার বন্ধ করতে হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরও এ শহরের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। এদিকেও নজর দিতে হবে।’
সকল আর্থিক খাতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভাঙাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেন নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম। এক্ষেত্রে দলীয় ‘পেশিশক্তিকে’ নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী তরিকুল সুজন।
এদিকে, সামষ্টিক চিন্তার আগে ব্যক্তিচিন্তায় পরিবর্তন আনার কথা তুলে ধরেন মহানগর জামায়াতে ইসলামের সাবেক আমীর মাওলানা মাঈনুদ্দিন আহমাদ। তিনি বলেন, ‘বদনামের চেয়ে আমাদের সুনামের ইতিহাস অনেক। কিন্তু আমরা অনেকে তা বলি না, জানিও না। ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে কিন্তু এখনও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। নিজে ভালো না হলে নারায়ণগঞ্জের ভালো চাইলে তো হবে না।’
চিকিৎসা খাতে উন্নয়নের তাগিদ দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক ও ছাত্র ফেডারেশনের জেলা সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা বলেন, ‘চিকিৎসা সেবার মান উন্নত করতে না পারলে একটি বাসযোগ্য নারায়ণগঞ্জ গড়ে তোলা যাবে না। এ শহরের লাইফ-লাইন শীতলক্ষ্যা নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে হবে। এমন একটি পরিচ্ছন্ন, ভয়হীন ও জবাবদিহিতার নারায়ণগঞ্জ আমরা চাই, যেখানে আমাদের শিশুরা মাঠে খেলবে, খালে-পুকুরে সাঁতার কাটবে।’
এই আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানোর পরও জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কেউ উপস্থিত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমএই’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। এই প্রশাসন থেকে প্রত্যাশার কিছু নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
একটি ইতিবাচক নারায়ণগঞ্জ গড়ার লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে শহরের যানজট নিরসনের কথা বলেন।
প্রেস ক্লাবের আরেক সাবেক সভাপতি ফজলুল হক রুমন রেজাও বলেন, যদি সাতদিনে যানজটমুক্ত করা সম্ভব হয় তাহলে অনেককিছু বদলে যাবে। কেননা এর সাথে শুধু রাজনৈতিক নয় প্রশাসনিক লোভও আছে।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খানও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমালোচনা করে বলেন, ‘প্রশাসনের লোকজন এখানে কেবল মধু খেতে আসেন। প্রশাসনকে শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগ তাদের থাকে না। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও দক্ষ করে তোলার জন্য নাগরিক পর্যায় থেকে চাপ বজায় রাখতে হবে।’
তিনি জেলার শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতেরও উন্নয়নের প্রতি তাগিদ দেন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন বলেন, চিকিৎসা খাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শিক্ষাখাতেও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
ফুটপাত হকারমুক্ত করে সাধারণ পথচারীদের হাঁটার সুযোগ করে দেওয়ার কথা তুলে ধরেন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক।
শিল্পঘন এ জেলার শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসলাম।
সন্ত্রাস ও দূষণমুক্ত নারায়ণগঞ্জ চান বলে জানান নাগরিক সংগঠন ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র সভাপতি মো. নূরউদ্দিন।
‘নিরাপদ ও শান্তিময় নারায়ণগঞ্জ’ গড়ার লক্ষ্যে সকলকে হাতে-হাত রেখে কাজ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ইসলামী আন্দোলনের মহানগর শাখার সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ।
বৈঠকে একাধিক বক্তা বিকেএমইএ’র বর্তমান নেতৃত্বে ‘ওসমান পরিবারের দোসররা’ এখনও বহাল রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তারা একইসাথে বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে ‘ওসমানীয় দোসর’ হিসেবে চিহ্নিত করে আর্থিক এ সংগঠনটির নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার দাবি জানান।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রশাসনকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সভাপতির বক্তব্যে মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘ডিসি-এসপিদের কর্মকাণ্ড নারায়ণগঞ্জবাসীর স্বপ্নের সাথে যায় না। আপনারা যদি ইতিবাচক কাজ করতে না পারেন তাহলে চলে যান। কাঁচের ঘরে বসে গরীবের কথা ভাবতে আপনারা পারবেন না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সমাধান আমরা চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যার সমাধান না করলে আমরা ট্যাক্স, গ্যাস বিল ও পানির বিল দেওয়া বন্ধ করে দেবো।’
সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ঐক্যের প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন। ‘স্বৈরাচারের দোসররা’ এখনও ব্যবসাখাত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, স্বৈরাচারের দোসররা নিজের থেকে সরে না গেলে সড়কে নামারও হুঁশিয়ারি দেন।
মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাসহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন।
এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর মহানগরের আমীর আব্দুল জব্বার, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু আল ইউসুফ খান টিপু, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি আরিফ আলম দিপু, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জীবন, প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু জাফর আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম কাজল, সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায়, নারী নেত্রী পপি রানী সরকার প্রমুখ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক দিপু।