
যুগের নারায়ণগঞ্জ:
নারায়ণগঞ্জ শহরের সবচেয়ে আলোচিত ক্রাইমজোন ইসদাইর—বছরের পর বছর এখানে রাজত্ব করেছে কুখ্যাত রাজ্জাক বাহিনী।
এলাকার ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই জানত, এই বাহিনীকে স্পর্শ করা মানে বিপদ ডেকে আনা। অথচ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা সংস্থা নিয়মিত এই এলাকায় ঘোরাফেরা করলেও কখনোই দেখা যায়নি সাঁড়াশি অভিযান কিংবা কঠোর নজরদারি।
অভিযোগ রয়েছে—বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা নিয়মিত মাসোয়ারা গ্রহণ করায় রাজ্জাক গ্রুপের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সাহসই দেখাতে পারেনি কেউ।
ফলে অপরাধের মাত্রা অল্পদিনে ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছায়। প্রকাশ্যে হামলা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক ব্যবসা ও অস্ত্রবাজি ছিল তাদের নিত্যকার কার্যকলাপ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাজ্জাক ও তার অনুসারীদের কাছে যেন পুরো পাড়া জিম্মি হয়ে ছিল।
৯৯৯ কলেই ভাঙল নীরবতা: ফতুল্লা থানার অভিযানে দেশীয় পিস্তল উদ্ধার
শনিবার (৬ ডিসেম্বর) রাত ১২টা ১৫ মিনিটে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ একটি কল আসে—ইসদাইর চাষাড়া রেললাইন এলাকার ফরিদা ক্লিনিকের পেছনে নাসিরের বাড়ির ‘৫২ ঘর’ ভবনের একটি কক্ষে সাগর নামে এক ব্যক্তিকে অজ্ঞাত কয়েকজন আটকে রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে অপরাধচক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই এলাকায় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ যে পুলিশের কাছে যেতে সাহস পেত না, সেই বাস্তবতাও স্পষ্ট।
তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফতুল্লা থানার ঈগল–২ টিম রাত ১২টা ৩৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছে হরমুজ মুন্সীর ভাড়াকৃত ঘরে তল্লাশি চালায়। সেখানে পাওয়া যায় ম্যাগাজিনযুক্ত একটি দেশীয় পিস্তল—যার গায়ে স্পষ্ট ঘষামাজার চিহ্ন। শুধু আটকে রাখা নয়, অস্ত্র মজুতের ঘটনা প্রমাণ করে এই চক্র কতটা সংগঠিত এবং বিপজ্জনক।
এর আগের রাতেই রাজ্জাক বাহিনীর অনুসারীদের তাণ্ডব
স্থানীয়দের তথ্য আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। আগের রাতেই রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাহফুজুর রহমান শুভ ও তার ১০–১২ সাঙ্গপাঙ্গ হানিফ নামের এক যুবকের কাছে “মোবাইল আছে” এমন অভিযোগ তুলে হরমুজ মুন্সীর ঘরে হামলা চালায়। তারা ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর, বাসিন্দাদের মারধর এবং পরে সবাইকে বের করে দিয়ে ঘরটি তালাবদ্ধ করে রাখে। অর্থাৎ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখলে না দেখার মতো অবস্থায় পুরো এলাকা যেন গ্যাংয়ের দখলে ছিল।
দ্বিতীয় অভিযানে উন্মোচিত রাজ্জাকের অস্ত্র ও মাদক ভান্ডার
৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে ‘ক’ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. হাসিনুজ্জামানের নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় অভিযানে রাজ্জাকের দখলে থাকা ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় দুইটি ম্যাগাজিন, তিন রাউন্ড গুলি, একটি খেলনা পিস্তল, সুইচ গিয়ার ছুরি, চারটি স্টিলের ছোরা, একটি দা এবং এক কেজি গাঁজা। যে পরিমাণ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার হয়েছে, তা স্পষ্ট করে যে রাজ্জাক ও তার গ্রুপ সাধারণ অপরাধী নয়—এরা দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র গোপন শক্তি গড়ে তুলেছিল।
রাজ্জাকের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণসহ একাধিক মামলা আগে থেকেই রয়েছে, তবুও তিনি এলাকায় ছিলেন রাজত্বকারী মাফিয়ার মতো স্বাধীনভাবে।
রাজধানীতেও রাজ্জাক বাহিনীর বিস্তার: পুত্র ওয়াসিম গ্রেপ্তার অস্ত্রসহ গাড়ি নিয়ে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে
আরো উদ্বেগজনক তথ্য হলো—রাজ্জাক শুধু নারায়ণগঞ্জেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার ছেলে ওয়াসিম (২২) রাজধানীর মুগদা এলাকায় অস্ত্রসহ গাড়ি নিয়ে ডাকাতির উদ্দেশ্যে বের হলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরিবারভিত্তিক এই অপরাধ সাম্রাজ্য যে শুধু স্থানীয় নয় বরং ঢাকাসহ বৃহত্তর এলাকায় বিস্তার ঘটিয়েছে, সেটি এবার স্পষ্ট।
কেন এতদিন অভিযান হয়নি ? দায় কার ?
এত অস্ত্র, এত মামলা, এত অভিযোগ—তারপরও রাজ্জাক বাহিনীকে বছরের পর বছর স্পর্শ না করার প্রশ্নটি এখন সবচেয়ে বড়। এলাকাবাসী মনে করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য নিয়মিত মাসোয়ারা নেওয়ায় কেউই চক্রটিকে ‘টাচ’ করতে আগ্রহী ছিল না। এজন্যই সাধারণ মানুষকে বারবার ৯৯৯-এর মতো প্ল্যাটফর্মে আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
এই অবস্থা শুধু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুরবস্থা নয়—এটি আইন অমান্যকারী গোষ্ঠীর কাছে রাষ্ট্রের পরাজয়ের শামিল।
শেষ কথা
৯৯৯-এর একটি কল পুরো চিত্রটাই বদলে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—
যে বাহিনী বছরের পর বছর অস্ত্র, মাদক, অপহরণ, ডাকাতি এবং হামলার মতো কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তাদের দমন করতে কি একটি ফোন কলের অপেক্ষায় থাকার কথা ছিল ?
রাজ্জাক বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অভিযান একদিকে যেমন ইতিবাচক, অন্যদিকে তেমনি তুলে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা, শৈথিল্য ও সম্ভাব্য দুর্নীতি। রাজধানী পর্যন্ত বিস্তৃত এই পরিবারভিত্তিক অপরাধ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এবার যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, নারায়ণগঞ্জের নিরাপত্তা ফিরে আসবে কীভাবে—এ প্রশ্ন এখন জনমনে।