
যুগের নারায়ণগঞ্জ:
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী বিহারী কলোনির সরু গলিতে সকালবেলা ভেসে আসে শিশুদের পড়ার সুর। ২৫ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মিত এক সেমিপাকা ভবনে চলে ‘এফপিও প্রিপারেটরি স্কুল’-এর ক্লাস। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক হাকিম মো. জয়নাল আবেদীন। যিনি গত ২৮ বছর ধরে প্রান্তিক বিহারী শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে।
হাকিম জয়নাল আবেদীনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ৫ অক্টোবর সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী এলাকায়। তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯৫ সালে, এইচএসসি ১৯৯৭ সালে- দু’টিতেই প্রথম বিভাগে।
পারিবারিক অর্থকষ্টের কারণে পড়াশোনার খরচ জোগাতে তিনি আদমজী জুট মিলে মেকানিক হিসেবে কাজ নেন। নিজের উপার্জনে পড়াশোনা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ইউনানী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় চার বছরের বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ‘মহাত্মা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ২০২২’ এবং ‘শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে পড়াশোনা শেষ করে জয়নাল আবেদীন দেখতে পান—বিহারী কলোনির প্রায় ২৫০০ পরিবারের মধ্যে এসএসসি পাস করেছেন মাত্র তিনজন।
জয়নাল আবেদীন বলেন, “তখন বিহারী শিশুদের স্কুলে ভর্তি হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। যারা আদমজী জুট মিলে চাকরি করতেন, কেবল তাদেরই সন্তানরা স্কুলে যেতে পারত। আমি ভেবেছিলাম, যদি কেউ না শেখায়, আমি অন্তত ওদের শেখাব।”
সেই ভাবনা থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘উম্মুল কুরা স্কুল’। বিনা বেতনে ১৬০-১৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় শিশু থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিও তখন শিক্ষকদের সামান্য ভাতা দিত।
দীর্ঘ ২৮ বছরের পথচলায় এখন তার উদ্যোগের নাম ‘এফপিও প্রিপারেটরি স্কুল’। ২৫ শতাংশ জায়গার ওপর তৈরি একটি সেমিপাকা ভবনে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে ক্লাস।
বর্তমানে এখানে ৬০০-এর বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বিহারী কলোনির শিশুদের জন্য এটি শুধু একটি স্কুল নয়- এটি তাদের জীবনের প্রথম আলোর জানালা।
স্কুলটিতে শিশু থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত উর্দু পাঠ আলাদাভাবে শেখানো হয়। এখানে সব শিক্ষকই স্থানীয় তরুণ ও শিক্ষিত যুবক, অনেকে খুব সামান্য বেতনে বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন।
জয়নাল আবেদীন বলেন, আমাদের লক্ষ্য শুধু বইয়ের পড়া নয়। আমি চাই, এই শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হোক, নিজেদের মানুষ হিসেবে দেখতে শিখুক।
জয়নাল আবেদীনের জীবনযাত্রা সহজ ছিল না। শিক্ষকতা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়লে তিনি নিজের ইউনানী চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ‘এজেড হাকিমী দাওয়াখানা’ নামে একটি ছোট চিকিৎসাকেন্দ্র খুলেন।
তিনি বলেন, চিকিৎসার দোকানটা আমার জীবনের অবলম্বন। কিন্তু শিক্ষকতা আমার আত্মার কাজ।
তার হাতে গড়া অনেক শিক্ষার্থী আজ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কেউ কলেজে ভর্তি হয়েছে, কেউ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী আসিফা জারদারী চান্দা বলেন, আমার প্রাথমিক শিক্ষা এই স্কুল থেকেই। এখন আমি মাস্টার্স শেষ করে আদমজী ইপিজেডে অফিসার হিসেবে কাজ করছি। জয়নাল স্যারের সহযোগিতায় আজ আমি মানুষ হতে পেরেছি।
আরেক প্রাক্তন ছাত্র মো. আলমগীর হোসেন বলেন, “জয়নাল স্যার না থাকলে আমি আজ এই জায়গায় থাকতে পারতাম না। তার অনুপ্রেরণায় আজ আমি মাস্টার্স শেষ করে এই স্কুলেই বাচ্চাদের পড়াই। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
এফপিও প্রিপারেটরি স্কুল এখন বিহারী সমাজে গর্বের জায়গা হয়ে উঠেছে। অনেক অভিভাবক চান, এই স্কুলটি সরকারি স্বীকৃতি পাক- যাতে তাদের সন্তানরাও বড় সুযোগ পায়।
জয়নাল আবেদীন বলেন, আমরা করুণা চাই না, আমরা চাই আমাদের সন্তানরাও দেশের অন্যদের মতো শিক্ষার সমান সুযোগ পাক।
দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চলেছেন হাকিম মো. জয়নাল আবেদীন। তিনি বিহারী শিশুদের জন্য শুধু একজন শিক্ষক নন, বরং আলোর প্রদীপ। তার এই দীপ্তি প্রমাণ করে আলোকিত মানুষই পারে প্রান্তিক জীবনে নতুন সূর্যোদয় আনতে।
ফরগটেন পিপল অর্গানাইজেশনের (FPO) প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মো. আলাউদ্দিন বলেন, আমরা মনে করি, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধু পড়াশোনা নয়। বরং মানুষ গড়ে তোলা। হাকিম জয়নাল আবেদীন সেই কাজটাই করে চলেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। তিনি যে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রান্তিক বিহারী শিশুদের জন্য শিক্ষা বিস্তারে কাজ করছেন, তা আমাদের কাছে এক অনুপ্রেরণার গল্প।
তিনি আরও বলেন, এফপিও প্রিপারেটরি স্কুল এখন শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি এক সামাজিক আন্দোলন। এই স্কুলের প্রতিটি শিশুর চোখে আমরা দেখেছি শেখার আগ্রহ, আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্ন দেখার সাহস। এই ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনে জয়নাল স্যারের পরিশ্রম, ধৈর্য আর ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। FPO এর পক্ষ থেকে আমরা এই উদ্যোগের পাশে আছি এবং থাকব। বর্তমানে আমরা স্কুলের শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন, পাঠ্যসামগ্রী ও ডিজিটাল শিক্ষা সামগ্রীর সরবরাহে সহায়তা করছি।