1. admin@jugernarayanganj.com : jugernaraya nganj nganj : jugernaraya nganj nganj
  2. multicare.net@gmail.com : যুগের নারায়ণগঞ্জ :
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৬ পূর্বাহ্ন

নারায়ণগঞ্জে গর্জে ওঠা জুলাই-আগস্ট : এক রক্তাক্ত অধ্যায়

প্রতিবেদকের নাম:
  • প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫
  • ৬১ বার পড়া হয়েছে

যুগের নারায়ণগঞ্জ:
২০২৪ এর জুলাই-আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। ওই সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ রাজধানী ঢাকা ছাড়িয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে আছড়ে পড়ে এক অভূতপূর্ব শক্তি ও আবেগ নিয়ে। ঢাকার পাশের এই গুরুত্বপূর্ণ জেলাটি হয়ে ওঠে দেশের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে রাজপথে নামে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা, শ্রমজীবী মানুষ এবং সাধারণ নাগরিক। দাবি ছিল সাম্য ও ন্যায়ের— জবাবে তারা পেয়েছে গুলি, গ্রেনেড আর মৃত্যু।

১৭ জুলাই : শান্তিপূর্ণ শুরু

নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের শুরুটা হয় ১৭ জুলাই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জ অংশে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তা বন্ধ করে নিজেদের দাবি জানান। যেন একটা শান্ত নদীর মতো আন্দোলন.. এতে আবেগ ছিল, ছিল বিভিন্ন সংগঠনের উপস্থিতি কিন্তু ছিল না কোনো সহিংস আচরণ।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা
১৮ জুলাই : ঢেউয়ের বিপরীতে বিদ্রোহের ঝড় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে। মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যায় রাজধানীর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের ১৫ জেলার যোগাযোগ। তবে শান্তিপূর্ণ সেই কর্মসূচি সহিংসতায় রূপ নেয় যখন চাষাড়ায় বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মিছিল থেকে পুলিশের ভ্যানে ভাঙচুর করা হয়। তখন পুলিশের সঙ্গে মাঠে নামে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের ক্যাডাররা। তারা আগ্নেয়াস্ত্র, রড ও চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসে ছাত্রদের দিকে। শহরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বারুদের গন্ধে। শতাধিক ছাত্র, পুলিশ, সাংবাদিক আহত হন।

১৯ জুলাই : রাজপথ রণক্ষেত্র
১৯ জুলাই শুক্রবার সকালেই সাইনবোর্ড থেকে মেঘনা, লিংক রোড থেকে সোনারগাঁও—সর্বত্র আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যায়। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ চলে। ফতুল্লা স্টেডিয়াম এলাকায় আগুন জ্বলে নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্কে। শামীম ওসমান গাড়িবহর নিয়ে মহড়া দেন, তার অনুসারীরা অস্ত্র হাতে শহরে নেমে আসেন।

শামীম ওসমান ও তার ক্যাডার বাহিনী
সেদিন বিকেলে ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা—ছোট্ট শিশু রিয়া গোপ নিজের বাসার ছাদে বাবার কোলে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। আর একটি মিছিলের পেছনে ছররা গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে বেশ কয়েকজন। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শহরময়। বিকেলে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়, পুলিশ বক্স এবং পিবিআই কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। ওপরে আকাশে চলে হেলিকপ্টার টহল, নারায়ণগঞ্জ যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নেয়।

২০ জুলাই : রক্তস্নাত শনিবার

এদিন হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হয় সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস। আন্দোলনকারীরা গলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ে। বিকেলে শিমরাইলের হাজী ইব্রাহিম কমপ্লেক্সে অবস্থিত শিমরাইল হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্প থেকে গুলি ছুড়লে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে লুটিয়ে পড়ে এক ছাত্র। মূহুর্তেই সেই কমপ্লেক্সের নিচতলায় আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা—যেখানে ছিল ব্যাংক, হাসপাতাল ও পুলিশের ক্যাম্প। আগুনে পুড়ে মারা যান ব্যাংকের ভেতরে সাজসজ্জায় কর্মরত তিন শ্রমিক, হতাহত হন শতাধিক মানুষ। যৌথ বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করা হয় পুলিশ সদস্যদের। এদিনই প্রাণ হারান গৃহবধূ সুমাইয়া আক্তার, বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেলিকপ্টার দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মারা যায় ১০ বছরের শিশু হোসাইন, যে বাবাকে খুঁজতে গিয়েছিল। শহীদ হন গজারিয়া পলিটেকনিকের ছাত্র মেহেদী হাসানসহ মোট ২২ জন।

২১-২২ জুলাই: কারফিউ ও নিস্তব্ধতা

সেনাবাহিনীর টহল, শহরের আকাশে হেলিকপ্টার, মহাসড়কে থেমে যাওয়া সবকিছু। আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়। কিন্তু শুরু হয় আরেক দুঃস্বপ্ন—ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শত শত মানুষকে। মামলা হয় ৩০টির বেশি, গ্রেপ্তার করা হয় ৬০০ জনের বেশি মানুষকে, যাদের অনেকেই কিশোর ও নিরপরাধ।

২৬-২৮ জুলাই : আদালতে কান্না
নারায়ণগঞ্জ আদালত চত্বর হয়ে ওঠে কান্না আর অপেক্ষার মিলনস্থল। স্বজনদের মুক্তির আকুতি, আইনজীবীদের ক্ষোভ, মামলার অনুলিপি না পাওয়ার অভিযোগ—সব মিলিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি।

৩ আগস্ট : ফের রাজপথে গণআন্দোলন
১২ দিন পর আবার রাজপথে নামে ছাত্র-জনতা। স্লোগান ওঠে—‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই।’ চাষাড়া শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক জোট আয়োজন করে ‘দ্রোহের গান ও কবিতা’। বিজিবির গাড়ি শহর ছেড়ে গেলে ছাত্ররা উল্লাসে ফেটে পড়ে। প্রতিশ্রুতি ভেঙে পুলিশ আবারও গুলি ছোড়ে রাস্তায় বসে থাকা আন্দোলনকারীদের ওপর।

৪-৫ আগস্ট : উল্লাস, বিদ্রোহ ও গুলি
৪ আগস্ট পুরো জেলা ছাত্র ও শ্রমজীবী মানুষের দখলে চলে যায়। এদিন ডিসি অফিসে হামলা, সংঘর্ষ, রাবার বুলেটে চারজন নিহত হন। পরদিন ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে শহরের বুক চিরে রাজধানীমুখী পদযাত্রা শুরু হয়। অনেককে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু অনেকেই নদীপথ বা পুরোনো সড়ক ধরে ঢাকায় পৌঁছে যান। চাষাড়ায় গুলিতে নিহত হন আবুল হাসান নামে একজন।

দুপরে শহরে ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর। উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। পটকা, মিষ্টি, পতাকা—গণতন্ত্র ফিরে পাবার উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হয় গোটা নারায়ণগঞ্জ।

জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ছাত্র আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের মোট ৫৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২১ জন নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা। অভ্যুত্থানের পর জেলাজুড়ে ১০২টি হত্যা এবং হত্যা চেষ্টা মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জেই দায়ের করা হয়েছে ৫৪টি। মামলায় আসামি করা হয় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় নেতাদের।

নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন চলাকালে হওয়া কিছু মৃত্যু এখনো কাঁদায় দেশবাসীকে। এ আন্দোলনে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয়, আড়াই মাসের মেয়েকে রেখে জানালায় দাঁড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সুমাইয়া আক্তার, বাবাকে খুঁজতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারায় ১০ বছরের হোসাইন মিয়া, আন্দোলনে এসে মাথায় গুলি লেগে শহীদ হন মেহেদী হাসান।

জুলাই-আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে থাকবে আগুন, কান্না ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে। এই শহরের রক্তস্নাত রাজপথ সাক্ষ্য দেবে—গণতন্ত্র, ন্যায় ও সমতার জন্য কতটা মূল্য দিতে হয়। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য প্রাণ দেওয়া শহীদেরা আর ফিরবেন না, কিন্তু ইতিহাসে তারা থাকবেন স্মৃতির প্রদীপ হয়ে।

আরো সংবাদ পড়ুন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট