যুগের নারায়ণগঞ্জ:
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনার তিন বছরের মাথায় সাবেক এক কাউন্সিলর ও তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। উচ্চ আদালত পরের বছর ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও বাকিদের সাজা কমিয়ে দেন। কিন্তু মামলাটি আপিল বিভাগে আটকে থাকায় দীর্ঘ ১১ বছরেও নিহত পরিবারগুলোর ন্যায়বিচারের অপেক্ষার অবসান হয়নি।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক (লিংক রোড) থেকে অপহরণের শিকার হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে তাদের মরদেহ।
হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্যরা হলেন- নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপন, স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও আইনজীবী চন্দনের গাড়িচালক ইব্রাহিম।
আদালতে রায় ঘোষণার পর দীর্ঘবছরেও তা কার্যকর না হওয়ার পেছনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনীহা কাজ করেছে বলে অভিযোগ নিহত পরিবারগুলোর সদস্য ও বাদীপক্ষের আইনজীবীর।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে ওই সরকারের পতন হওয়ার পরও আপিল বিভাগে মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়ায় চাপা ক্ষোভ রয়েছে নিহত পরিবারগুলোতে।
জাহাঙ্গীর যখন খুন হন তখন তার স্ত্রী শামসুন্নাহার আক্তার নুপুর সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। আগামী জুলাই মাসে তাদের একমাত্র কন্যা রোজা আক্তার জান্নাতের বয়স ১১ বছর হবে। স্থানীয় একটি হাফেজিয়া মাদরাসায় পড়ছে রোজা। বাবার মৃত্যুর একমাস পর জন্ম নেওয়া রোজার কাছে বাবা মানে কেবল তার পুরোনো ছবি। তা আকড়েই বাবা হারানোর বেদনা প্রশমনের চেষ্টা ছোট্ট এই শিশুর।
“জন্মের পর আমি আমার বাবাকে দেখি নাই, আদর-স্নেহ পাই নাই। মাদরাসায় আমার বান্ধবীদের তাদের বাবা দিয়ে আসে, আবার নিয়েও যায়। অনেক সময় রাতে মা কিংবা দাদি ব্যস্ততার কারণে আমাকে নিতে আসতে দেরি হলে আমি বাবাকে খুব মিস করি। বাবা বেঁচে থাকলে তিনিই আমাকে মাদরাসায় দিয়ে আসতেন এবং নিয়ে আসতেন”, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন শিশু রোজা।
রায় কার্যকরের দীর্ঘসূত্রিতায় আসামিরা শাস্তি পাবেন কিনা তা নিয়েও সন্দিহান জাহাঙ্গীর স্ত্রী শামসুন্নাহার। হতাশার সুরে তিনি বলেন, “এই ঘটনার পর সারাদেশ তোলপাড় হইয়া গেলো। কিন্তু সেই হত্যার বিচারও যে ১১ বছর ধইরা আটকাইয়া থাকবো তা কখনো ভাবি নাই। মেয়ে তো এখন বড়, বিচারের কথা জিজ্ঞেস করে, কিন্তু উত্তর দিতে পারি না। খুনিগো শাস্তিটা দেখলে অন্তত শান্তি পাইতাম।”
‘সরকারি লোকজন’ জড়িত ছিল বলে এই হত্যার রায় কার্যকর হয়নি বলেও মন্তব্য করেন এ নারী।
“আওয়ামী লীগ সরকার তো নাই, এখনও এই বিচারের কাজ শেষ হয় না কেন”, এ প্রশ্নও রাখেন তিনি।
মৃত্যুর আগে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান নিহত তাজুলের পিতা আবুল খায়ের। তিনি বলেন, “বর্তমানে যে সরকার আছে তারা তো জানেন কীভাবে খুনটা করা হয়েছে। সিভিল লোকের প্ররোচনায় পইড়া আইনের লোকেরা এই ঘটনা ঘটাইলো। আমরা বিচার দেখার আশায় আছি। দুইজনের বাবা ইতোমধ্যে মারা গেছেন। আমরাও বিচার দেখে যেতে পারবো কিনা তা নিয়ে সন্দেহ।”
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত এই মামলার রায়ে সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে যান।
২০১৮ সালের আগস্টে উচ্চ আদালত ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। এরপর আপিল করা হয়। কিন্তু গত সাত বছর ধরেই মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) আবুল কালাম আজাদ।
ঘটনার দিন একটি মামলায় হাজিরা শেষে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হয়েছিলেন। তবে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
দীর্ঘ বছরেও এই মামলার আসামিরা শাস্তি না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বলেন, “নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের জন্য যদি শাস্তি না হয়, তাহলে অপরাধীরা আরও সাহস পেয়ে যাবে। নিম্ন ও উচ্চ আদালতে রায় হওয়ার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় আমাদের মধ্যে আতঙ্ক থাকে সবসময়।”
নজরুলের বড় ছেলে তরিকুল ইসলাম বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় এমএসসি করছেন। ছোট ছেলে জাহিদুল ইসলাম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং একমাত্র মেয়ে নাজিফা ইসলাম একটি মেডিকেল কলেজে পড়ছেন।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নজরুলের স্ত্রী বলেন, “তাদের বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে-মেয়েরা ভালো জায়গায় পড়াশোনা করবে, জীবনে সফলতা পাবে। তার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু সেটা দেখার জন্য লোকটাই বেঁচে নেই।”
মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে থাকলেও বিগত বছরগুলোতে এর কোনো শুনানি হয়নি জানিয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী ও মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, “নারায়ণগঞ্জে বিচারিক আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেছে ২০১৭ সালে। এরপর কয়েকজনের সাজা কমালেও পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। আমরা ভেবেছিলাম, এই রায় কার্যকর হলে দেশে যে হত্যা, গুমের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল সেটি বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার আসামিদের দিয়ে অ্যাপিলেট ডিভিশনে রিভিশন আবেদন দাখিল করায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই রিভিশন আপিলের শুনানি আর হয়নি।”
“মামলাটি অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত শুনানি বিষয়ে আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ এটা চায়নি। তৎকালীন সরকার আসামিদের প্রচ্ছন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। এটি একটি ওয়েল প্রুভড কেস। আমরা আশা করি, দেরিতে হলেও এই মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্দেশনা দিবে।”
তবে, তবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবুল কালাম আজাদ বলেন, “মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এই মামলাটির বিষয়ে খুবই আন্তরিক। অন্তর্বর্তী সরকারও চাচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই মামলাটির চূড়ান্ত রায় দ্রুত করতে।”